Grate Legend Jyoti Basu

Community ( in Orkut ) Cilck on Picture 4 add

Tuesday, January 19, 2010

জ্যোতি বসু ( Jyoti Basu ) : জীবনপঞ্জি ১৯১৪-২০১০


জ্যোতি বসু : জীবনপঞ্জি ১৯১৪-২০১০


১৯১৪ : ৮ জুলাই কলকাতার হ্যারিসন রোডে, বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড, জ্যোতি বসুর জন্ম হয় । প্রথমে তাঁর নাম ছিল জ্যোতিকিরণ । কিরণ শব্দটি পরে তাঁর নাম থেকে বাদ পড়ে । কিন্তু তাঁর খ্যাতির সঙ্গে কিরণ শব্দটি ‘আসলে’ জুড়েই ছিল । ডাকনাম গনা । পিতা নিশিকান্ত বসু ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক । চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল । মায়ের নাম হেমলতা দেবী । তিনি ছিলেন মা-বাবার তৃতীয় পুত্র। দাদা সৌরিন্দ্রকিরণ, দিদি সুধা দেবী । ঠাকুরদার চাকরি সূত্রে বাবা-কাকারা আসামের ধুবড়িতে বাস করলেও তাঁর পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ‘বারদি’-তে । নিশিকান্ত বসু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে কলকাতায় ডাক্তারি শুরু করেন । হ্যারিসন রোডের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি চলে আসেন বর্তমান ‘এলিট’ সিনেমার উল্টোদিকের ‘হিন্দুস্থান বিল্ডিং’-এ ।


১৯২০ : ছয় বছর বয়সে তিনি ধর্মতলার ‘লরেটো ডে স্কুল’-এ ভর্তি হন । ওই স্কুলে চার বছর পড়ার পরিবর্তে এক বছর ‘ডবল প্রমোশন’ পেয়ে তিন বছর পড়েন ।


১৯২৩ : সেণ্ট জেভিয়ার্স স্কুলে সেকেন্ড স্ট্যান্ডার্ডে ভর্তি হয়ে ইণ্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছিলেন ।

১৯২৪ : দিক্ষণ কলকাতায় ৫৫-এ ‘হিন্দুস্থান পার্ক’-এ নিজস্ব বাড়ি তৈরি হলে সেই বাড়িতে উঠে আসেন ।


১৯৩২ : ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ।


১৯৩৫ : বি এ পাস করে ব্যারিস্টারি পড়বার জন্যে ব্রিটেনে যান । ভর্তি হন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে । ইংল্যান্ডে ভি কে কৃষ্ণমেননের নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়া লিগ’ প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে ভারতের স্বাধীনতার পেক্ষ কাজ করছিল, জ্যোতি বসু ছিলেন লিগের সক্রিয় সদস্য । লন্ডন, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ছাত্রদের পৃথক ‘কমিউনিস্ট গ্রুপ’ গঠিত হয় । প্রকাশ্যে পার্টির সভ্য না হলেও গ্রুপের সদস্যরা পার্টির কাজ করতেন । পার্টির ক্লাস নিতেন হ্যারি পলিট, রজনীপাম দত্ত, ক্লিমেন্স দত্ত, বেন ব্র্যাডলে প্রমুখ। সে সময়ে বন্ধুত্ব হয় ভূপেশ গুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্য, রজনী প্যাটেল, পি এম হাকসার, মোহন কুমারমঙ্গলম, ফিরোজ গান্ধী প্রমুখ রাজনীতিকের । ভারতের স্বাধীনতার জন্য লন্ডনে পড়ুয়া ছাত্ররা তৈরি করেন ইন্ডিয়া লিগ । এর মধ্যমণি ছিলেন কৃষ্ণ মেনন । জ্যোতি বসুর মার্কসবাদী সাহিত্য পাঠের শুরু সেখান থেকেই । ব্রিটেনে ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান স্টুডেণ্টস’ ১৯৩৬-এর শেষ দিকে পুনর্গঠিত হলে এবং এর মুখপত্র ‘ভারতীয় ছাত্র ও সমাজতন্ত্র’ প্রকাশিত হলে তিনি সংগঠনের কাজে সাহায্য করেছিলেন । ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে ‘লন্ডন মজলিস’ গঠিত হলে প্রথমে সদস্য পরে সেক্রেটারি নিযুক্ত হন ।


১৯৩৮ : তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অফ ব্রিটেনের সদস্যপদ পান ।

১৯৩৯ : সুভাষচন্দ্র বসু ত্রিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে ‘লন্ডন মজলিস’ এক সমাবেশে জমায়েত হয় এবং সমাবেশ থেকেই সুভাষচন্দ্রকে অভিনন্দন-বার্তা পাঠানো হয়েছিল । সেই সমাবেশে জ্যোতি বসু ছাড়াও বক্তৃতা দিয়েছিলেন এন কে কৃষ্ণন । ব্যারিস্টারি পাস করে জ্যোতিবাবু ফিরে আসেন কলকাতায় । হাইকোর্টে যোগ দিলেও তাতে তাঁর মন টেকেনি ।


১৯৪০ : লন্ডন থাকতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারতে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে কাজ করবেন । ফেরার পথে বোম্বাইতেই ভূপেশ গুপ্ত, মোহন কুমারমঙ্গলম, অরুণ বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন । যোগ দেন পার্টিতে ।


১৯৪১ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির হাতে সোবিয়েত রাশিয়া আক্রান্ত হওয়ার পর কলকাতায় পার্টি মঞ্চ হিসেবে ‘সোবিয়েত সুহৃদ সমিতি’ · এফ এস ইউ — এবং ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙঘ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি প্রথম সম্পাদক নির্বাচিত হন । হিটলার সোবিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে কলকাতায় তৈরি হয় ফ্রেন্ডস অফ সোবিয়েত ইউনিয়ন নামে সংস্থা । জ্যোতিবাবু তার আহ্বায়ক । সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে তিনি যোগ দেন
। কমিউনিস্ট হিসেবে শ্রমিক ফ্রণ্টে কাজ শুরু করেন । আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অল ইন্ডিয়া রেলওয়েমেনসের সহ-সভাপতিও হন ।


১৯৪২ : তিনি অনুকূল ঘোষের কন্যা ছবি ঘোষকে বিবাহ করেন । বিয়ের অল্পদিন পর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয় । জুলাই মাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার । মায়ের মৃত্যু ।


১৯৪৪ : পার্টির নির্দেশে বন্দর ও ডাক শ্রমিকদের সঙঘটিত করার কাজে হাত দেন । নানা কারণে ওই কাজে তিনি সফল হতে পারেননি । পরে তাঁকে রেলওয়ে শ্রমিকদের কাছে পাঠানো হয় । তিনি ‘বেঙ্গল আসাম রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’ গঠন করতে সক্ষম হন । ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক । এ ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নের কাজে যুক্ত ছিলেন ।


১৯৪৫ : বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য · পি সি ও — নির্বাচিত ।

১৯৪৬ : বাংলা - আসাম রেলওয়ে কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে হুমায়ুন কবিরকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছিলেন । সেই নির্বাচনে তিনি ছাড়া দার্জিলিং কেন্দ্রে রতনলাল ব্রাহ্মণ এবং দিনাজপুর কেন্দ্র থেকে রূপনারায়ণ রায় কমিউনিস্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন । তিনজনকে নিয়ে একটি পৃথক গ্রুপও গঠিত হয়েছিল । সদস্য হিসেবে তিনি যে বেতন পেতেন তা পার্টিকে দিয়ে দিতেন, পার্টি তাঁকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল । আইন সভার সদস্য হয়ে তিনি প্রথম বক্তৃতা দিয়েছিলেন ।


১৯৪৬ সালের ২৫ জুলাই । বিষয় ছিল খাদ্যসঙ্কট। তখনই তাঁর বাকচাতুর্য ও উপস্থিত বুদ্ধি তাঁকে প্রথম সারির নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে ।


১৯৪৮ : স্বাধীন ভারতে ২৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে ওই দিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় । এটাই ছিল তাঁর প্রথম কারাবরণ । তিন মাস পর তিনি মুক্তি পান । ৫ ডিসেম্বর তিনি দ্বিতীয়বারের জন্যে বিবাহ করেছিলেনবীরেন্দ্রনাথ বসুর কন্যা কমল বসুকে ।

১৯৪৯ : পার্টি তখনও বেআইনি, গ্রেপ্তার এড়িয়ে কাজ করার জন্যে আত্মগোপন করে কাজ চালাতেন ।


১৯৫০ : সেপেটম্বর মাসে পুনরায় গ্রেপ্তার হন । হাইকোর্টের নির্দেশে


১৯৫১ এর ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পান ।


১৯৫০ - এর ২৭ ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টি বৈধ বলে ঘোষিত হয় ।


১৯৫১ : পার্টির মুখপত্র ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ পত্রিকা নবপর্যায়ে প্রকাশিত হলে তিনি সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মনোনীত হয়েছিলেন । রাজ্য কমিটির সদস্য ।


১৯৫২ : প্রথম বিধানসভার নির্বাচনে বরানগর কেন্দ্র থেকে ৫৪.২০ অংশ ভোট পেয়ে তিনি তৎকালীন মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী হরেন্দ্রনাথ চৌধুরিকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন । বিধানসভায় পার্টির পরিষদীয় দলের নেতা, পরে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত । সেপেটম্বরে একমাত্র পুত্র চন্দনের জন্ম হয় ।


১৯৫৩ : কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলনে তিনি ছিলেন সম্পাদক । ১৯৫৬, ১৯৫৮, ১৯৫৯ ও ১৯৬০ সালের রাজ্য সম্মেলনেও তিনি সম্পাদক ছিলেন । মাদুরাইতে অনুষ্ঠিত পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য । পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদ
ক । তারপর ধীরে ধীরে পলিটব্যুরোর সদস্য হন । ট্রাম-ভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলনে অংশগ্রহণ। ভাড়া কমানোর আন্দোলনে জয়ী হন ।


১৯৫৪ : শিক্ষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ।


১৯৫৫ : গোয়া মুক্তি আন্দোলনে যোগদান। চীন যাত্রা।


১৯৫৬ : বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং তা রদ করেন ।

১৯৫৭ : দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে বরানগর কেন্দ্র থেকে পুনরায় জয়লাভ করেন । বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টির পরিষদীয় দলের নেতা এবং একই সঙ্গে বিরোধীপেক্ষর নেতা নির্বাচিত হন ।


১৯৫৭ - ৬৭, একটানা দশ বছর তিনি বিরোধী নেতা ছিলেন । এই পদের জন্যে প্রাপ্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা তিনি গ্রহণ করেননি । ঘটনাবহুল পরিষদীয় জীবনে তাঁর বক্তৃতাগুলি স্মরণীয় হয়ে আছে । চেকোস্লোভাকিয়া ও সোবিয়েত ইউনিয়ন সফর ।


১৯৫৯ : খাদ্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ। গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ জুলাই থেকে ৯ সেপেটম্বর জেলে থাকেন । ১১-১৪ নভেম্বর জাতীয় পরিষদের মিরাট সেশনে যোগদান।

১৯৬১ : স্বেচছায় রাজ্য কমিটির সম্পাদকের পদ ত্যাগ করলে ওই পদে নির্বাচিত হন প্রমোদ দাশগুপ্ত। সোবিয়েত ইউনিয়ন সফর ।


১৯৬২ : চীন-ভারত যুদ্ধের সময় গ্রেপ্তার হন। জেলে থাকাকালীন বাবার মৃত্যু। বরানগর কেন্দ্র থেকে পুনর্নির্বাচিত। হায়দরাবাদে জাতীয় পরিষদের সভায় যোগদান। সোবিয়েত দেশ ভ্রমণ।


১৯৬৪ : ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হলে তিনি সি পি আই · এম — দলে যোগ দেন । এবং সেই বছর থেকেই তিনি দলের পলিটব্যুরোর সদস্য। ৩১ অক্টোবর কলকাতায় পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে উদ্বোধনী ভাষণ দেন ।


১৯৬৫ : ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’ প্রকাশিত। সম্পাদক জ্যোতি বসু ।

১৯৬৬ : খাদ্য আন্দোলনে আবার কারাবরণ । অসুস্থ হয়ে পড়লে জেল হাসপাতালে ভর্তি হন । মার্চের ১৪ তারিখে মুক্তি পান ।


১৯৬৭ : বরানগর থেকে আবার নির্বাচিত। প্রথম যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রিসভা গঠন । ২ মার্চ তিনি উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন । অর্থমন্ত্রকও তাঁর দায়িত্বে ছিল । অন্তর্কলহে যুক্তফ্রণ্ট ৯ মাসের মধ্যেই ভেঙে যায় । উত্তরবঙ্গে চা-শ্রমিকদের আন্দোলন, পরে জমি দখল, ফসল কাটা ইত্যাদিতে কৃষকদের যোগদানকে কেন্দ্র করে ২৫শে পুলিসের গুলিচালনায় ন’জন প্রাণ হারান । শুরু হয় নকশালবাড়ি আন্দোলন।


১৯৬৯ :মধ্যবর্তী নির্বাচনে বরানগর থেকে পুনর্নির্বাচিত। দ্বিতীয় যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রিসভায় সহকারী মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্র ও সাধারণ প্রশাসন দপ্তরের ভার পেয়েছিলেন । মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি।


১৯৭০ : ৩১ মার্চ পাটনা রেল স্টেশনে তাঁকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা। আলি ইমাম নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয় ।


১৯৭১ : দু’বার তাঁর ওপর আক্রমণ হয় । চেষ্টা হয় প্রাণনাশের। মধ্যবর্তী নির্বাচনে বরানগর থেকে অজয় মুখার্জিকে হারিয়ে পুনর্নির্বাচিত।


১৯৭২ : বিধানসভা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে সি পি আই প্রার্থীর কাছে পরাজিত । ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানি
, বেলজিয়াম ভ্রমণ। ব্যাপক রিগিংয়ের অভিযোগ এনে তাঁরা বিধানসভা বয়কট করেন ।


১৯৭৪ : রেল ধর্মঘট।


১৯৭৫ : ইন্দিরা গান্ধীর আমলে সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি ।


১৯৭৭ : বিধানসভা নির্বাচনে সাতগাছিয়া কেন্দ্র থেকে সর্বাধিক ভোট লাভ করে জয়ী হন । নির্বাচিত বামফ্রণ্ট প্রার্থীদের হিসেবে মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ গ্রহণ করেন । শপথ নেন ২১ জুন । যুগোস্লাভিয়া ও ব্রিটেন ভ্রমণ।


১৯৭৯ : রোম, বেলগ্রেড, ওয়ারশ ও জেনিভা ভ্রমণ।

১৯৮০ : লন্ডন, মস্কো ও হাঙ্গেরি সফর ।


১৯৮১ : লন্ডন, জেনিভা, প্যারিস ভ্রমণ।


১৯৮২ : একই কেন্দ্র থেকে পুনরায় নির্বাচিত। মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়াও স্বরাষ্ট্র, প্রশাসন, অর্থ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর । হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি থেকে উঠে আসেন রাজভবনে । ভুটান সফর ।


১৯৮৩ : সোবিয়েত ইউনিয়ন সফর । বুদাপেস্ট, প্যারিস, আমস্টারডাম ও লন্ডন যাত্রা।


১৯৮৪ : চীন ও হংকং যাত্রা করেন মে মাসে । ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড এবং পরে কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর । রাজ্যে নতুন শিল্পনীতি ঘোষিত হয় ।

১৯৮৫ : ইংল্যান্ড ও জার্মান ভ্রমণ। অ‘ফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অফ ইকনমি‘ বক্তৃতা। সোবিয়েত ইউনিয়ন সফর ।


১৯৮৬ : আত্মজীবনী ‘জণগণের সঙ্গে’ প্রকাশিত। লন্ডন, প্যারিস, রোম, জেনেভা, এথেন্স, ব্যাঙ্কক ও সিঙ্গাপুর সফর ।


১৯৮৭ : সাতগাছিয়া কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করে তৃতীয়বার বামফ্রণ্ট মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী। রাজভবন থেকে বাসা বদল করে সল্টলেকে ইন্দিরা ভবনে । ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর । বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করেন । এরপরও তিনি বিনিয়োগ আনার জন্য ইউরোপ, আমেরিকা যান ।


১৯৮৮ : জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ভ্রমণ।

১৯৮৯ : ইংল্যান্ডে হাউস অফ কমনস-এ মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরি এবং স্কুল অফ ওরিয়েণ্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাজিড-এ বক্তৃতা। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফর ।


১৯৯১ : সাতগাছিয়া কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে চতুর্থবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত। ব্রিটেন সরকারের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড, সুইডেন ও জার্মানি সফর ।


১৯৯২ : ইংল্যান্ড, হামবুর্গ, রোম ও ফ্লোরেন্স ভ্রমণ।


১৯৯৩ : ইংল্যান্ড ও কিউবা ভ্রমণ। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ।


১৯৯৪ : ইংল্যান্ড ও সুইৎজারল্যান্ড ভ্রমণ।

১৯৯৫ : পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা।


১৯৯৬ : সাতগাছিয়া কেন্দ্র থেকে পঞ্চমবারের জন্য ভোটে জিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত। দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে জ্যোতি বসুর নাম প্রস্তাব। ১৪ মে সি পি এম কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রে তৃতীয় জোট সরকারে সি পি এম বাইরে থেকে সমর্থন জানাবে । জ্যোতি বসু এই সিদ্ধান্তকে মনে করেন ‘ঐতিহাসিক ভুল’ । বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে গঙ্গা জলবণ্টন সমস্যা সমাধানে তাঁর বিশেষ ভূমিকা । বাংলাদেশের বারদি-তে পৈতৃক বাড়িতে যান ।

১৯৯৭ : দিল্লির রাজনৈতিক টানাপোড়েনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা । সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত ‘জ্যোতি বসু: দি অথোরাইজড বায়োগ্রাফি’ গ্রন্থ প্রকাশ। ৩০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল কর্তৃক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ‘বৈদগ্ধ’ পত্রিকার জ্যোতি বসু বিশেষ সংখ্যার। ‘জ্যোতি বসু’ তথ্যচিত্রের শুটিং শুরু করেন চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষ। জ্যোতি বসুর আত্মজীবনী ‘উইথ দ্য পিপল’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন বিনয় চৌধুরি। ইংল্যান্ড ও দিক্ষণ আফ্রিকা ভ্রমণ।


১৯৯৯ : ইসরায়েল ভ্রমণ । কলকাতা-ঢাকা বাস চলাচল শুরু । প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তিনিও ঢাকা আমন্ত্রিত।


২০০০ : ২৮ জুলাই সি পি এম কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের মধ্যেই হঠাৎ অসুস্থ । প্রথমে রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে, পরে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেসে ভর্তি করা হয় । পরদিন সন্ধ্যায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় । ১৫ আগস্ট নিজেই জানান সেপেটম্বরের ১৫ তারিখের পর মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অবসর নেবেন । ৩ নভেম্বর শেষবারের মতো মহাকরণ ছাড়লেন । ৫ নভেম্বর রাজারহাটে আবাসিক ভবনে শেষ সরকারি অনুষ্ঠানে যোগদান । ৬ নভেম্বর নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে বিদায় সংবর্ধনা এবং একই সঙ্গে
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ । একটানা ৮৫৪০ দিন মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিলেন । ‘সেণ্টার অফ ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়নস’, ‘হলদিয়া রিজিওনাল কমিটি’ পরিকল্পিত ‘জ্যোতি বসু: লাইফ অ্যান্ড টাইম’ অ্যালবাম প্রকাশিত । ৭ ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের বন্যায় কেন্দ্রীয় সাহায্যের দাবিতে দিল্লির বিঠলভাই প্যাটেল হাউসে ধর্নায় বসেন জ্যোতি বসু । ১০ ডিসেম্বর, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, এইচ ডি দেবগৌড়া, রাবড়ি দেবী, প্রফুল্ল মহন্ত প্রমুখ বিশিষ্ট নেতার উপস্থিতিতে জ্যোতি বসু সংবর্ধনাসভা অনুষ্ঠিত হয় সল্টলেক যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। প্রধান উদ্যোক্তা রাজ্য বামফ্রণ্ট কমিটি । ১২ ডিসেম্বর, জলপাইগুড়ি, শহরে সংবর্ধনা। প্রসঙ্গত, এই শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে দোমহনিতে রেল-শ্রমিক অান্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর প্রথম প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রবেশ ঘটেছিল ।


২০০১ : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ‘প্রশংসা বিষবৎ, নিন্দা অমৃতসমান’ । ৫৫ বছর পর শেষবারের মতো বিধানসভা ছেড়ে যাওয়ার সময় এই কথাই বলে গেলেন ।


২০০৩ : ৩০ সেপেটম্বর, স্ত্রী কমল বসুর মৃত্যু । তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর ।


২০০৪ : ১৬ আবর, উত্তরবঙ্গ সফর । ২৪ ডিসেম্বর, সিঙ্গাপুর যাত্রা।

২০০৫ : ২৭ জানুয়ারি, রাজস্থানের ‘ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ ইন এডুকেশন’ · ডিমড ইউনিভার্সিটি— কর্তৃক বিশেষ সম্মান । ৩১ এপ্রিল, গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘জ্যোতি বসুর সঙ্গে’ তথ্যচিত্রের প্রথম প্রদর্শন হয় নন্দনে । ২৩ জুলাই, বাথরুমে পড়ে গিয়ে আহত । ৯ ডিসেম্বর, বসিরহাটে হেমন্ত ঘোষাল নামাঙ্কিত ভবন উদ্বোধন করেন । ২৩ ডিসেম্বর, তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, কিন্তু তিনি নিতে রাজি হননি ।


২০০৬ : ২৩ জানুয়ারি, তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘আকাশ বাংলা প্রযোজিত’ চারটি সিডি-র সংগ্রহ ‘অন্তরঙ্গ জ্যোতি বসু’ প্রকাশিত হল । ১৪ নভেম্বর বাড়িতে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পান ।


২০০৭ : ১৭ মার্চ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি লিট সম্মান । ১৫ জুলাই, কলকাতা পুরসভা টাউন হলে নাগরিক সম্মান দিতে চাইলে তিনি অসম্মতি জানান ।


২০০৮ : ৪ সেপেটম্বর, নিজের বাড়িতে আবার পড়ে গিয়ে কপাল ও মাথায় আঘাত । কপালে দুটি সেলাই করতে হয় । ৭ সেপেটম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন । সিটি স্ক্যান করতে হয় ১০ সেপেটম্বর । ১২ নভেম্বর, আবার পড়ে যান বাড়িতে । ৭ ডিসেম্বর, তাঁর বাড়িতে এসে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করে যান আর্জেণ্টিনার ফুটবল খেলোয়াড় মারাদোনা।


২০০৯ : ২০ ফেব্রুয়ারি, দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে
যোগ দিতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে রাজ্য দপ্তরে যান । ১২ জুলাই, বাড়িতে হঠাৎ জ্ঞান হারান । হাসপাতালে ভর্তি হন । ১৭ জুলাই, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন ‘জ্যোতি বসুর বারদি গ্রামের বাড়ি সংরিক্ষত করা হচেছ ।’


২০১০ : ১ জানুয়ারি, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি । সতের দিনের দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ১১টা ৪৭ মিনিটেজ্যোতি বসুর জীবনাবসান হয়

জ্যোতি বসু ( Jyoti Basu )


জ্যোতি বসু (৮ জুলাই, ১৯১৪ - ১৭ জানুয়ারি, ২০১০) একজন ভারতীয় বাঙালি রাজনীতিবিদ । তিনি সিপিআই (এম) দলের সদস্য । ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা তেইশ বছর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন । তিনিই ছিলেন ভারতের দীর্ঘতম মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী । এছাড়াও ১৯৬৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিপিআই(এম) দলের পলিটব্যুরো সদস্য ছিলেন ।


ছাত্রাবস্থায় উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে গিয়ে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন বসু । ১৯৪০ সালে গ্রহণ করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ । ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের প্রাদেশিক আইনসভায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি রূপে নির্বাচিত হন । দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত হন জ্যোতি বসু । ড. বিধানচন্দ্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বে তিনি হন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা । ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের পর বসু যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) দলে । ১৯৬৭ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন জ্যোতি বসু । এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ জুন শপথ নেন পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে । ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নাম বিবেচিত হলেও, তিনি পার্টির সিদ্ধান্তে সেই পদ প্রত্যাখ্যান করেন । টানা ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করে অবসর নেন বসু । মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর শাসনকাল সাফল্য ও ব্যর্থতায় মিশ্রিত । তবে বিলেত-ফেরত বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের প্রতিনিধি বসু ছিলেন এক অবিসংবাদী জননেতা এবং নিজের দল ও দলের বাইরেও এক বিশিষ্ট সম্মানের অধিকারী ।



জীবনী


প্রারম্ভিক জীবন


ডা: নিশিকান্ত বসু ও হেমলতা বসুর তৃতীয় সন্তান জ্যোতি বসুর জন্ম ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই কলকাতার ৪৩/১ হ্যারিসন রোডস্থ (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) বাসভবনে । তাঁর প্রকৃত নাম ছিল জ্যোতিরিন্দ্র বসু; ডাকনাম ছিল গনা । পিতা নিশিকান্ত ছিলেন এক প্রথিতযশা ডাক্তার এবং মা হেমলতা ছিলেন এক গৃহবধূ । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতামাতা ওল্ড হিন্দুস্তান বিল্ডিং-এর (বর্তমান ফুটনানি চেম্বার) একটি ভাড়াবাড়িতে উঠে আসেন । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতারই ৫৫এ হিন্দুস্তান রোডস্থ নিজস্ব বাসভবনে উঠে আসেন তাঁরা । উল্লেখ্য, বসু পরিবারের আদিনিবাস ছিল ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের ঢাকা জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার) বারদী গ্রামে । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ছয় বছর বয়সে ধর্মতলার লোরেটো স্কুলে ভর্তি হন বসু । এই সময় নিশিকান্ত বসু পুত্রের নামটি সংক্ষিপ্ত করে রাখেন জ্যোতি বসু লোরেটোর কিন্টারগার্টেনের পাঠক্রমটি ছিল চার বছরের । কিন্তু একটি "ডাবল প্রোমোশন" পাওয়ায় বসু তিন বছরেই এই পাঠক্রম সমাপ্ত করেন । প্রথম শ্রেণি থেকে লোরেটো পুরোদস্তুর বালিকা বিদ্যালয় । কিন্তু সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে না পেরে আরও এক বছর লোরেটোতেই মেয়েদের সঙ্গে এক বছর পড়েন জ্যোতি বসু । এরপর ১৯২৫ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন তিনি । এই স্কুল থেকেই সিনিয়র কেমব্রিজ (নবম শ্রেণি) পাস করেন তিনি । ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক (অনার্স) সহ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন তিনি । জানা যায়, কলেজে পিছনের বেঞ্চে বন্ধু রহমানের সঙ্গে বসতে পছন্দ করতেন তিনি । গ্র্যাজুয়েশন সম্পূর্ণ করার পর ১৯৩৫ সালে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার্থে তিনি যুক্তরাজ্যে গমন করেন । এই সময় পিতার ইচ্ছায় তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতেও অবতীর্ণ হন; তবে উত্তীর্ণ হতে পারেননি । কিন্তু ব্যারিস্টারি পড়া অব্যাহত থাকে । লন্ডনে অবস্থানকালে সেখানকার ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে গড়ে ওঠা লন্ডন মজলিশের তিনি ছিলেন প্রথম সম্পাদক । কথিত আছে, ১৯৩০-এর দশকের শেষভাগে হ্যারল্ড ল্যাস্কির বক্তৃতা শুনতে যেতেন তিনি । ইংল্যান্ডে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হন তিনি। বিশিষ্ট কমিউনিস্ট দার্শনিক ও লেখক রজনী পাম দত্ত কর্তৃক কমিউনিস্ট মতাদর্শে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন জ্যোতি বসু । মিডল টেম্পলে ব্যারিস্টারি পাঠ ও যোগ্যতা অর্জনের পর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি । কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতির জন্য নাম লেখালেন । পিতার আগ্রহে বাসন্তী ঘোষের সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হলো অচিরেই । কিন্তু অল্পদিন পরেই স্ত্রী বিয়োগ হয় । ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে মাতার মৃত্যু হলো । পরবর্তীতে বিয়ে হয় কমল বসুর সঙ্গে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ।



রাজনৈতিক কর্মজীবন


তাঁর বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন ডাক্তার । দুই জ্যাঠামশাই ওকালতি করতেন । রাজনীতির সঙ্গে এ পরিবারের তেমন সংযোগ ছিল না । তবে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতা ছিল । ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিক নিশিকান্ত বসুর বারদির বাড়িতে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করেছিলেন । এখানে অস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন । পুলিশের খানা-তল্লাশীর সময় জ্যোতি বসুর মা তাঁর শাড়ীর ভাজেঁ অস্ত্রটি লুকয়ে রেখেছিলেন । এই যোগসূত্র জ্যোতি বসুর মধ্যে জাগিয়ে তোলে দেশপ্রেম ; একসময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে ফেলে । ১৯৩০ দশকের শুরুর দিকে গান্ধিীর অনশনের সময় একদিন তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন স্বত: প্রবৃত্ত হয়ে । এ সময়ই অক্টরলোনি মনুমেন্টে (শহীদ মিনার ময়দান) সুভাষ বসুর ভাষণ শুনতে গেলেন খদ্দর পরে । সেদিন পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করলে তাঁর মনে পলায়নের পরিবর্তে মোকাবেলার অনুভূতি জেগে উঠেছিল । আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, "সেটাই বোধহয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ । "লন্ডনে আইন পড়তে এসে রাজনীতিতে তাঁর দীক্ষা হয় । ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে আইন পড়তে পড়তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, আইন নয় রাজনীতিই হবে জীবনের ব্রত । তখন বিশ্বে ফ্যাসীবাদী অভ্যূত্থান শুরু হয়েছে । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ । লন্ডন স্কুর ইকনমিক্সে হ্যারল্ড লাস্কির বক্তৃতা শুনতে শুনতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে পড়তেন । এসময় কার্ল মার্কস দাস ক্যাপিটাল এবং এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ইত্যাতি পড়তে শুরু করলেন । সে সময় জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে আইন পড়তে এসেছিলেন মার্কসবাদে দীক্ষিত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ভূপেশ গুপ্ত । ভূপেশ গুপ্ত এবং স্নেহাংশু আচার্যের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হলো কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট বিটেনের সঙ্গে । রজনী পাম দত্ত, বেন ব্রাডলি, হ্যারি পলিট প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তাঁকে উজ্জীবিত করেছিল প্রবলভাবে । মজলিশের সদস্য হিসেবে নানা দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলেন । ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস-এর পুনসংর্গঠনে নিযুক্ত করলেন নিজেকে । পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৯৩৮-এ লন্ডনে এলে তাঁর সংবর্ধনা আয়োজনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন । নেহরুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই জ্যোতি বসু তাঁর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে জানিয়ে দেন তাঁরা ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান । নেহরু জবাব দিয়েছিলেন, 'আগে ভারতবর্ষ স্বাধীন হোক পরে সমাজতন্ত্রের কথা ভাববো' । এসময় নেতাজী সুভাষ বোসও লন্ডনে এসেছিলেন । তাঁর ভাষণ জ্যোতি বসুর বিশেষ ভালো লেগেছিল । সাক্ষাতে তিনি বলেছিলেন দেশে ফিরে তিনি রাজনীতি করতে চান । ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল । মিডল টেম্পল থেকে বার অ্যাট ল হয়ে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতি বসু দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলেন । আর রাজনৈতিক জীবন শুরু হলো শ্রমিক নেতা হিসাবে ।


বিরোধী রাজনীতি


১৯৪৬ সালে মাত্র বত্রিশ বছর অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত হন জ্যোতি বসু । এই সময় থেকেই আইনসভায় বিরোধী নেতার ভূমিকা পালন করতে থাকেন বসু । ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বামপন্থীরাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেন । স্বাধীনতার পূর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেভাগা আন্দোলন ও বঙ্গবিভাগ নিয়ে আইনসভায় বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তিনি । স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, বন্দীমুক্তি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত আন্দোলনের পুরোভাগে থাকেন জ্যোতি বসু । এই সময় একাধিকবার বিভিন্ন কারণে কারারুদ্ধও হতে হয় বসু সহ তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতাদের



প্রথম নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা


১৯৪০-এর দশকে জলপাইগুড়ি শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে দোমহনিতে রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন জ্যোতি বসু । এখানকার কৃষক ও চা শ্রমিকদের সংগঠন তৈরি ও তেভাগা আন্দোলনেও তাঁর অবদান ছিল। দোমহনি থেকেই বেঙ্গল আসাম রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতা বসু ১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় কংগ্রেসের হুমায়ুন কবিরকে মাত্র আট ভোটে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন বসু। এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি মোট তিনটি আসন পেয়েছিল । জ্যোতি বসুর সঙ্গে দার্জিলিং কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন অপর কমিউনিস্ট নেতা রতনলাল ব্রাহ্মণ




বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভা (১৯৪৬-৪৭)


১৯৪৬ সালের ১৪ মে নবগঠিত প্রাদেশিক আইনসভার প্রথম বৈঠক বসে

। এই দিন রাজবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে জ্যোতি বসু একটি মুলতুবি প্রস্তাব দিয়েছিলেন । প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল । পরে সেই মুলতুবি প্রস্তাব পুনর্বিচারের জন্য অস্থায়ী স্পিকার ডি গ্ল্যাডিং-এর নিকট আবেদন জানান, কিন্তু গ্ল্যাডিং এই প্রস্তাব গ্রহণে অসম্মতি জানান জুলাই মাসে বাজেট অধিবেশন বসলে প্রথমেই বন্দী মুক্তির প্রসঙ্গে আইনসভা সোচ্চার হয় জ্যোতি বসু পুনরায় এই প্রসঙ্গে একটি মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করলে স্পিকার তা প্রত্যাখ্যান করেন । কারণ জানতে চাইলে, মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী কিছু বলতে যান বসু উত্তরে বলেন যে তিনি স্পিকারের রুলিং মেনে চলবেন, মুখ্যমন্ত্রীর নয় । কংগ্রেসের কিরণশঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ সদস্য বসুকে সমর্থন করেন এবং বাইরে অপেক্ষমান হিন্দু-মুসলমান ছাত্র শোভাযাত্রার কাছে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ জানান । এই নিয়ে বিধানসভায় বেশ উত্তেজনা হয় । সোহ্‌রাওয়ার্দী এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৫ অগস্টের মধ্যে রাজবন্দীদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন । বন্দীরাও মুক্তি পান । উল্লেখ্য, এই বন্দীমুক্তির ব্যাপারে জ্যোতি বসুকমিউনিস্ট পার্টিই মূলত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং আইনসভায় তাঁরা কংগ্রেসের সহায়তাও পেয়েছিল। এই বাজেট বক্তৃতায় জ্যোতি বসু পাটশিল্প, কয়লাশিল্প ইত্যাদির রাষ্ট্রায়াত্ত্বকরণ এবং জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের সুপারিশ করেন আসাম প্রদেশে মুসলিম অনুপ্রবেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বসু বলেন জমিদারদের অত্যাচারের ফলেই দরিদ্র মুসলমানগণ বাস্তুভিটে ত্যাগ করে আসামে যেতে বাধ্য হচ্ছেন । এইজন্য জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের পাশাপাশি ভূমিহীনদের মধ্যে জমিবণ্টন ও শিল্পবিকাশ ত্বরান্বিত করে বাস্তুত্যাগ বন্ধ করার জন্যও সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আবেদন জানান তিনি । ৬ অগস্ট আইনসভায় প্রবেশের পথে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সামসুদ্দোহা কর্তৃক নিগৃহীত ও পরে গ্রেফতার হন বসু । কিরণশঙ্কর রায় স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অবিলম্বে যথোচিত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান । অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায় । স্পিকারের নির্দেশে সোহ্‌রাওয়ার্দী সামসুদ্দোহাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন । সোহ্‌রাওয়ার্দী এ নিয়ে তদন্তেরও নির্দেশ দেন । আইনসভায় দলমত নির্বিশেষে সকল সদস্যই পুলিশের এ হেন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন । স্পিকারও পুলিশের এই ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন


রাজনৈতিক জীবন ১৯৪৭-১৯৬৪


১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ঔপনিবেশক শাসনের অবসান হলো, স্বাধীন হলো ভারত । স্বাধীনতা লাভের উৎসব শেষ হলে নতুন উদ্যমে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়ো্গ করলেন জ্যোতি বসু

কমিউনিস্ট পার্টির নতুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি বা 'পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি' গঠন করা হলো - জ্যোতি বসু এ কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হলেন । ২১শে নভেম্বর পুনর্গঠিত পশ্চিম বঙ্গ বিধান সভার অধিবেশন । এ সময় এসপ্ল্যানেডে মিছিলের ওপর লাঠি

চালালো পুলিশ, নিক্ষেপ করলো কাঁদানে গ্যাস । কংগ্রেস আবির্ভূত হলো জনগণের শত্রু হিসেবে । এ সময় 'পশ্চিম বঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা আইন' নামে একটি জনবিরোধী প্রণয়ন করা হয় জ্যোতি বসু এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন । এই কালা কানুনের বিরূদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেন তিনি । ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ তারিখে কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। পরদিন জ্যোতি বসুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলো । প্রেসিডেন্সী জেলে শুরু হলো বসুর প্রথম কারাজীবন । তিন মাস পর মুক্তি পেলেন তিনি। কারামুক্ত হয়ে আবার রেলওয়ে ট্রেড ইউনিয়নের কাজে মনোনিবেশ করলেন তিনি। বম্বে যাওয়ার পথে ট্রেনে উঠে পুলিশ তাকে আবার গ্রেপ্তার করলো । আলিপুর কোর্টে জামিন মিললো না ; তাকেঁ যেতে হরো আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে । তবে অচিরেই খালাস পেলেন তিনি । ৫ই ডিসেম্বর ১৯৪৮ আলিপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বীরেন্দ্রনাথ বসুর কন্যা কমল বসুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন তিনি । বিয়ের পর তিন মাস পুরো হওয়ার আগেই আবার তাঁকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নিল পুলিশ । তাকেঁ এবার আত্মগোপন করে থাকতে হলো, ছদ্মবেশ নিয়ে পথে বেরুতেন । ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১ লা সেপ্টেম্বর পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন তিনি । হেবিয়াস কর্পাস করে হাইকোর্টের আদেশে ১৯৫১তে মুক্তি পেলেন তিনি । মুক্তি পেযে কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্সংগঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জ্যোতি বসু । ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে । তেলেঙ্গানায় কারাগারে আটক রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য দিল্লী গিয়ে নেহরুর সঙ্গে দেখা করলেন তিনি । ১৮ই জানুয়ারী ১৯৫২'র বিধানসভার নির্বাচনে বরাননগর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে জিতে গেলেন জ্যোতি বসু । এবার বিধানসভায় তিনি বিরোধী পক্ষের নেতা মনোনীত হলেন । বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক আইনের বিরূদ্ধে তিনি শক্ত অবস্থান নিয়ে অটল ছিরেন । ১৯৫৩-এ কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন তিনি । পার্টি সংগঠনের দায়িত্ব বেড়ে গেল অনেক




রাজনৈতিক জীবন ১৯৬৪-১৯৭৭



১৯৬০-এর দশকে জ্যোতি বসুর ওপর বেশ কয়েক বার হামলা হয় । ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের আগের দিন বরাননগরে এক শ্রমিক সমাবেশে যাওয়ার পথে কংগ্রেসী পতাকা হাতে একদল সন্ত্রাসী তাঁর গাড়ীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ৩য় সাধারণ নির্বাচনের প্রচারের কাজে কাকদ্বীপ যাওয়ার পথে শতখানেক লোক তাঁর পথ আগলে হামলা করে । ১৬ ফ্রেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি বরাননগর এলাকা থেকে ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জিকে পরাজিত করে বিধানসভার সদস্য হলেন ; বিধানসভায় বিরোধীয় দলীয় নেতাও হলেন তিনি



১৯৬২'র ২০শে জুন চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হরে সারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নেমে আসে নির্যাতন । কালীঘাটে কুশপুত্তিলিকার দোকানে জ্যোতি বসুর কুশপুত্তলিকা বিক্রয় হতো । তাঁকে "চীনের দালাল", "দেশদ্রোহী" ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে রাস্তায় সেগুলো পোড়ানো হতো । গোয়েন্দা পুলিশ সর্বত্র অনুসরণ করতো তাকে । যুদ্ধ স্থায়ী হলো মাত্র ১৪ দিন ; কিন্তু ইত্যবসরে জ্যোতি বসুকে এক কাকডাকা ভোরে গ্রেপ্তার করে টানা ১ বছর কারাবন্দী করে রাখা হলো । ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয় । ১৯৬৫-৬৬ এ খাদ্য আন্দোলন, বন্দীমুক্তি আন্দো্লন, ট্রামভাড়াবৃদ্ধি আন্দোলনো উত্তাল এক সময় । এ সময় জ্যোতি বসুকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় । ১৯৬৬'র ১৪ মার্চ তিনি মুক্তি পেলেন



ইতোমধ্যে পশ্চিম বঙ্গে কংগ্রেস সম্পর্কে জনগণের মোহভঙ্গ হয়েছে । ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৪র্থ সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের আধিপত্য খর্ব হলো । গঠিত হলো অ-কংগ্রেসী কোয়ালিশন সরকার । ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২রা মার্চ জ্যোতি বসু দ্বিতীয় বারের মতো পশ্চিম বঙ্গের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন । শুরু হলো ট্রেজারী বেঞ্চের জীবন ; শুরু হলো বুজোর্য়া রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বামপন্থী সরকার পরিচালনার দুরূহ সংগ্রাম জ্যোতি বসুর মূল পুজিঁ তাঁর নেতৃত্বের ওর সাধারণ মানুষের আস্থা । ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে জ্যোতি বসু পুনর্বার বরাননগন থেকে নির্বাচিত হলেন, আবার বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলো ; জ্যোতি বসু আবারো উপ মুখ্যমন্ত্রী । স্বরাষ্ট্র দায়িত্ব পেয়ে তিনি পুলিশকে "জনগণের বন্ধু" হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন । কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা এবং যুক্তফ্রন্টের ঐক্য বজায় রাখা এই দ্বিবিধ সমস্যার মধ্য দিয়ে পথ চলতে হচ্ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নকশাল আন্দোলন । অজয় মুখার্জিকে হারিয়ে জ্যোতি বসু নির্বাচিত হলেন । মাত্র তের মাসের মাথায় ২১শে মার্চ ১৯৭০ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হয়



৯ই মার্চ ১৯৭১-এ অনুষ্ঠিত হলো মধ্যবর্তী নির্বাচন । কিন্তু রাজনীতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে । সরকার গঠন হতে না-হতেই জারী করা হলো রাষ্ট্রপতির শাসন । পরবর্তী নির্বাচন ১১ মার্চ ১৯৭২ জ্যোতি বসুর ভাষায় "বাহাত্তরের নির্বাচনটা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের এক নির্লজ্জ প্রহসন। ... আমি সেদিন আমার নির্বাচনী এলাকা বরাননগরে ঢুকতেই পারিনি ।" প্রশাসন সম্পূর্ণ বৈরী । জালিয়াতির মাধ্যমে শিবপদ ভট্টাচার্য জিতে গেলেন জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি বিধান সভা বর্জন করে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল বেছে নিল




পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ১৯৭৭-২০০০


অবসর জীবন


২০০০ সালের ২৮ জুলাই সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক চলাকালীন হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন জ্যোতি বসু । তাঁকে প্রথমে ভর্তি করা হয় রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে; পরে নিয়ে যাওয়া হয় অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসে । চিকিৎসার পর পরদিন সন্ধ্যায় ছাড়া পান জ্যোতি বসু । ১৫ অগস্ট নিজেই জানান ১৫ সেপ্টেম্বরের পর অবসর নিতে চলেছেন তিনি । তবে পার্টির চাপে অবসরের তারিখ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে যায় । ৩ নভেম্বর শেষ বারের মতো পশ্চিমবঙ্গ সচিবালয় মহাকরণে আসেন জ্যোতি বসু । ৫ নভেম্বর রাজারহাট নিউটাউনে একটি আবাসিক ভবনের অনুষ্ঠানে যান; এটিই ছিল তাঁর জীবনের শেষ সরকারি অনুষ্ঠান । একটানা ৮৫৪০ দিন মুখ্যমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার পরিচালনার পর ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বিদায় সংবর্ধনা সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিলেন জ্যোতি বসু



৭ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বন্যাত্রাণে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের দাবিতে দিল্লির বিঠলভাই প্যাটেল হাউসে ধরনায় বসলেন জ্যোতি বসু । ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, এইচ. ডি. দেবেগৌড়া, রাবড়ি দেবী, প্রফুল্ল মহন্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রাজ্য বামফ্রন্ট কমিটির উদ্যোগে জ্যোতি বসুর সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হল । ১২ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি শহরে অনুষ্ঠিত হল সংবর্ধনা সভা । উল্লেখ্য, এই শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে দোমহনিতে রেলশ্রমিক আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমেই তিনি প্রথম বার প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামে নেমেছিলেন । ২০০১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্যপদ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে বিধানসভার সঙ্গে বসুর ৫৫ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হল । বিধানসভায় বসুর শেষ বার্তা ছিল ‘প্রশংসা বিষবৎ, নিন্দা অমৃতসমান’ । তবে অবসর গ্রহণের পরও বিধাননগরের মুখ্যমন্ত্রী আবাস ইন্দিরা ভবনেই তাঁর আজীবন বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়



২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর উত্তরবঙ্গ সফরে যান জ্যোতি বসু । ২৪ ডিসেম্বর যান সিঙ্গাপুর সফরে । ২০০৫ সালের ২৩ জুলাই বাথরুমে পড়ে গিয়ে আহত হন বর্ষীয়ান এই নেতা । এই বছরই নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)-এর অষ্টাদশ পার্টি কংগ্রেস জ্যোতি বসুকে দলের পলিটব্যুরো সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত করে । যদিও জ্যোতি বসু নিজে শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই পদটি থেকে অব্যহতি চেয়েছিলেন । ২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি পুনরায় বার্ধক্যের কারণে দলীয় পদ থেকে অব্যহতি চান । কিন্তু সেই সময় তাঁর এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয় । সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট জানিয়েছিলেন, ২০০৮ সালের পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত তাঁরা জ্যোতি বসুকে দলীয় পদে চান । তারপর এই কংগ্রেসেই তাঁর অনুরোধ বিবেচনা করা হবে । ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ঊনবিংশ পার্টি কংগ্রেসে জ্যোতি বসুকে আর পলিটব্যুরোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না । যদিও তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পলিটব্যুরোর বিশেষ অতিথির মর্যাদা দেওয়া হয় । ২৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করতে চাইলে তা গ্রহণে অসম্মত হন জ্যোতি বসু । ২০০৬ সালের ১৪ নভেম্বর আবার বাড়িতে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পান তিনি



২০০৭ সালের ১৭ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জ্যোতি বসুকে সাম্মানিক ডি. লিট. সম্মান প্রদান করে । ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বাড়িতে পড়ে গিয়ে কপালে ও মাথায় আঘাত পান জ্যোতি বসু । ৭ সেপ্টেম্বর ভর্তি হন হাসপাতালে । ১২ নভেম্বর আবার বাড়িতে পড়ে গিয়ে আহত হন জ্যোতি বসু । ৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার প্রাক্তন ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা এসে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন । ২০০৯ সালের ১৩ মে বাথরুমে পড়ে গিয়ে বাঁ পায়ে আঘাত পান জ্যোতি বসু । জুন মাসে নির্বাচনী সাফল্যের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন । ১২ জুলাই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন অ্যাডভান্সড মেডিকেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (আমরি হসপিটাল) । সেবার সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন জ্যোতি বসু



সর্বশেষ অসুস্থতা ও জীবনাবসান


২০১০ সালের ১ জানুয়ারি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বসু বিধাননগরের অ্যাডভান্সড মেডিকেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (আমরি হসপিটাল) ভর্তি হন । ১৬ জানুয়ারি তাঁর শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক হয় এবং তাঁর একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যেতে থাকে সতের দিনের দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ১১টা ৪৭ মিনিটে জ্যোতি বসুর জীবনাবসান হয় । তাঁর দেহের সৎকার হবে না - তিনি তাঁর চোখ দান করে গেছেন ; তাঁর মরদেহ ব্যবহৃত

হবে মেডিক্যাল কলেজের গবেষণায় । তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে ১৮ জানুযারী ২০১০ সোমবার সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে



সমালোচনা


বিভাগোত্তর ভারতে অতুলনীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী জ্যোতি বসুর জীবনের প্রকৃত অর্জন কী এ নিয়ে রাজনৈতিক সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে । ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাট থেকে কংগ্রেসকে তিনি কেবল উৎখতই করেন নি, পরবর্তী তিন যুগে কংগ্রেসের প্রভাব তিনি বহুলাংশে খর্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তবে আপাদমস্তক মার্ক্সবাদী জ্যোতি বসুর পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি । দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি নাগাড়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার পরিচালনা করেছেন । রাষ্ট্রযন্ত্রে তাঁর নেতৃত্বের সাফল্য কী সে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে । তাঁর শাসনাকালে পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখ করবার মতো কোন অর্জন নেই এমন ইঙ্গিতও করা হয়েছে । বলা হয়েছে তাঁর আমলে পশ্চিমবঙ্গে স্থিতাবস্থা বিরাজ কররেও তেমন কোন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেনি